>আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা প্রাণ

Posted: November 2, 2010 in ALL ARTICLE

>

আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা প্রাণ

শো ক লে খ ন

আহমাদ মাযহার

আবদুল মান্নান সৈয়দ এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। মৃতু্যর মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেও যিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, পরিকল্পনা করেছেন নতুন নতুন লেখার তিনি চলে যেতে পারেন কী করে! ব্যক্তিগতভাবে আমি সৌভাগ্যবান যে তাঁর মতো মানুষের সানি্নধ্য পেয়েছিলাম। গত এক বছর ধরে প্রায়ই সকালের দিকে আমাকে টেলিফোন করে তাঁর সাহিত্যিক ভাবনার কথা জানাতেন, কত পরিকল্পনা ছিল তাঁর লেখার! বাংলা সাহিত্যের সব সম্পদকে যেন আগলে বসেছিলেন তিনি। একটাও যেন হাত ফসকে বেরিয়ে না যায়! এই তো মাত্রই কয়েকদিন আগে সুকান্তের কবিতার ওপর এক অন্তর্ভেদী আলোচনা লিখে তাঁর গভীর পাঠ অভিজ্ঞতা ও রসবিচারের ক্ষমতা দেখিয়ে আমাদের বিস্মিত করে দিলেন। তাঁর সমগ্র সত্তা ছিল সাহিত্যে নিবেদিত। যে সমাজ পরিপাশ্বর্ের মানুষ ছিলেন তিনি সে সমাজে আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো মানুষের জন্ম নেয়া প্রায় অসম্ভব। এ-রকম একজন মানুষের সৃষ্টিশীলতা অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনে নেয়া যায় না। এই তো চরম অসুস্থতার মধ্যেও প্রায় অসুরের মতো লিখেছেন তিনি। এবারের ঈদ সংখ্যার জন্য গল্প-স্মৃতিকথা-কবিতা-জানর্াল-সমালোচনার যেন তুবড়ি ছুটিয়েছিলেন অসুস্থ শরীরেরও। এরই মাঝখানে আমার সম্পাদিত বইয়ের জগৎ-এর মতো ছোট কাগজের জন্য যত্ন করে লিখেছেন দীর্ঘ বই-সমালোচনা। লিখেছেন গভীরতা স্পশর্ী অন্তরিকতায় পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত গদ্যরচনা। সারাক্ষণ তিনি সাহিত্যে নিমগ্ন থাকতেন গভীর ভালোবাসায় ও নিখাঁদ আত্মনিবেদনে আচ্ছন্ন হয়ে।

আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন বাংলাসাহিত্যের এমন এক সম্পদ যাঁর কথা লিখে শেষ করা যায় না। বহুপ্রজতায় তাঁর তুলনীয় মানুষ সমগ্র বাংলাভাষার সাহিত্যিক মহলে তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে কিংবা সামান্য আগে-পরে নেই বললেই চলে। তিনি ছিলেন কবি, শুধুমাত্র কবি নন, সমক্ষমতাসম্পন্ন গল্পকার, অনেকগুলো ভালো কাব্যনাট্য লিখেছিলেন। নভেলাও লিখেছিলেন কয়েকটি। কিন্তু অবিরল লিখেছেন কবিতা বিষয়ক গদ্য। বাংলাভাষার প্রধান কবি ও কথাসাহিত্যিকদের কথা লিখেছেন অবিশ্রাম। খ্যাত স্বল্পখ্যাত বা অখ্যাত লেখকদের সৃষ্টিসার আবিষ্কারে তাঁর তুলনা কই! বাংলা কবিতার তিন দিকপাল রবীন্দ -নজরুল-জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর গভীর পঠনপাঠনের তুলনীয় দেখি না। মুখ্য ও গৌণ কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে অবিরাম ও অবিরল ধারায় লিখে গেছেন।

সেই কৈশরোত্তীর্ণ কাল থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দের সৃষ্টিকর্ম আস্বাদ করে আসছি। আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখছি তিনি আমার কাছে তখনও ছিলেন বিস্ময়ের আধার, তাঁর কবিতা যেন এমন এক বিস্ময়ের সামগ্রী যার স্মৃতি অবিরাম তাড়া করে ফেরে। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭) এমন এক চূড়ায় উত্তীর্ণ করেছিল তাকে যে জ্যোৎস্নারৌদ্রের চিকিৎসার (১৯৬৯) কিংবা ও সংবেদন ও জলতরঙ্গর (১৯৭৪) উজ্জ্বলতাও তাকে মস্নান করতে পারেনি। পরে একসময় মনে হয়েছিল তাঁর কবিসত্তা বোধ হয় নিঃশেষিত হয়ে এসেছে। পরাবাস্তবের জগৎ কত আর সমৃদ্ধি দেবে তাঁর কবিসত্তাকে! যৌবনে পরাবাস্তবতার যে বিষ্ফার ঘটেছিল তাঁর তা বুঝি বার্ধক্যের বাস্তবতায় নেতিয়ে এসেছে। নির্বাচিত কবিতায় (১৯৭৫) নতুনে পুরানোয় মিলেমিশে নতুন কোনো পথে যাত্রা করেনি। কিন্তু কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২)-এ বর্তমানকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন ভিন্ন এক পরাবাস্তব কবিতা। পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২) ও পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি (১৯৮৩) হয়ে মাছ সিরিজ-এর (১৯৮৪) আশ্চর্য রাস্তায় আমাদের হাঁটবার পথ দেখালেন তিনি। তাতেও ক্ষান্ত দেননি কবি। তারপর বাঁক ফেরালেন আর এক নিরালা রাস্তায়! মাঝে লিখলেন সনেট নিরীক্ষা আমার সনেট (১৯৯০), তারপর লিখলেন সকল প্রশংসা তাঁর (১৯৯৩), যার রয়েছে সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র ভুবন। হামদস্বভাবের ভিন্ন এক স্বাদের কবিতা সেগুলো। মনে হয়েছিল এ-জগৎ থেকে বুঝি আর ফিরবেন না তিনি! কিন্তু আশ্চর্য আবার যেন পুনর্জন্ম ঘটেছে তাঁর! লিখলেন নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা (১৯৯৭), যেন আর এক জগতে নিয়ে গেলেন তিনি আমাদের। বষর্ীয়ান মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞা এসে ভর করল এ পর্বের কবিতায়। আবার এক নির্বাচিত কবিতা (২০০২) প্রকাশিত হল নতুন পুরনোয় মিশেলে কবিতার এক সংকলন। এরপর প্রকাশিত হল মাতাল কবিতা পাগল গদ্য (২০০৬), হে বন্ধুর বন্ধু, হে প্রিয়তম (২০০৬), কবিতার বই (২০০৭) ইত্যাদি প্রেমময় কবিতার বই। কবিতার অনুবাদেও তার কৃতি অসামান্য যার নিদর্শন মাতাল মানচিত্র (১৯৭০) ও বিদেশী প্রেমের কবিতা। এর মধ্যে মান্নান সৈয়দকে পাওয়া যায় নতুন মাত্রায়, নতুনতর চমকে। এছাড়াও কবিতায়-কবিতায় নাটক লিখলেন, এন্তার নাটক, যার কদর করতে হলে পাঠকেরও প্রয়োজন যোগ্যতার। নাট্যসমগ্র (২০০৭) যার নিদর্শন হয়ে আছে।

প্রথম গল্পের বই সত্যের মতো বদমাশ (১৯৬৮) আলোড়ন তুলেছিল। পাকিস্তানি সামরিক সরকার নিষিদ্ধ করেছিল বইটি। স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরায় পাঠকদের কাছে পৌঁছায়। এরপর চলো যাই পরোক্ষের (১৯৭৩) স্বতন্ত্র ভুবনে এল গল্প। মৃতু্যর অধিক লাল ক্ষুধার (১৯৭৭) পর যেন স্তিমিত হয়ে আসে তাঁর গল্পযাত্রা। নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭) তাঁর পুরোনো-নতুনের সম্মিলিত গল্প সংকলন। তারপরই বেরিয়েছিল উৎসব (১৯৮৮)। এরপর গল্প লিখলেও গল্পে তাঁর বিরতি পড়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর বের হল তার নেকড়ে হায়না আর তিন পরি (১৯৯৭), বের হল মাছ মাংস আর মাৎসর্যের রূপকথা (২০০১), এরপর নব পরিকল্পিত নির্বাচিত গল্প (২০০২), যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল নতুন ও পুরনো গল্প! গল্পের বই প্রকাশে আবারও বিরতি কাটাতে এল কেন আসিলে ভালোবাসিলে (২০১০)। একটি বৃহদায়তন গল্পসংগ্রহের পাণ্ডুলিপি প্রসতূয়মান ছিল।

পরিমাণের দিকে সবচেয়ে বেশি তিনি লিখেছিলেন প্রবন্ধ-সমালোচনা ও স্বাধীন গবেষণাপত্র। জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে প্রথম বই শুদ্ধতম কবি (১৯৭২) লিখে একেবারে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর একে একে বের হয় নির্বাচিত প্রবন্ধ প্রথম খণ্ড (১৯৭৬) ও দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৮৭), নজরুল ইসলাম :কবি ও কবিতা (১৯৭৭), করতলে মহাদেশ (১৯৭৯), দশ দিগন্তের দ্রষ্টা (১৯৮০), বেগম রোকেয়া (১৯৮৩), আমার বিশ্বাস (১৯৮৪), ছন্দ (১৯৮৫), সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ (১৯৮৬), নজরুল ইসলাম :কালজ ও কালোত্তর (১৯৮৭), চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯), পুনর্বিবেচনা (১৯৯০), দরোজার পর দরোজা (১৯৯১), ফররুখ আহমদ : জীবন ও সাহিত্য (১৯৯৩), বিবেচনা পুনর্বিবেচনা (১৯৯৪), স্মৃতির নোটবুক (১৯৯৭), রবীন্দ নাথ (২০০১), আধুনিক সামপ্রতিক (২০০১), নির্বাচিত কলাম (২০০৭), অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ ১, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলার ইন রেসিডেন্স হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি বই বেরিয়েছিল নজরুল বিষয়ে; বিশ শতকের শিল্প আন্দোলন (২০০৬) নামে একটি শিল্প বিষয়ক বইও রয়েছে তার। এই যে বইগুলোর কথা উলিস্নখিত হল এর বাইরে বাংলা একাডেমী থেকে কয়েকটি জীবনী লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন রচনা কত যে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকায় ও লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় তার হিসেব করা বা খোঁজ করা নিবিষ্ট গবেষকের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব। বাংলাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ খুব কম লেখাই পাওয়া যাবে যার সম্পর্কে তিনি লেখেননি। অন্তত কবি ও কবিতা বিষয়ে তাঁর রচনাপ্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য তুলনাহীন।

তাকে অনেক সময় বদরাগী বা মুডি মনে হতো, এক ধরনের কপট গাম্ভীর্যও দেখাতেন অনেক সময়, কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশবার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন কী দিলখোলা মানুষ ছিলেন তিনি। আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। সাধারণ রেস্টুরেন্টে বসতেন তিনি তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। ডায়েরি-স্মৃতিকথা-চিঠির মিশেলে কবিতায়িত এক ধরনের গদ্যসংরূপ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। আমার সম্পাদিত বইয়ের জগৎ পত্রিকায় একের পর এক লিখেছিলেন দীর্ঘ বই সমালোচনা যা তাঁর সাহিত্যিক সত্তার এক সর্বংসহা সংরূপ হয়ে উঠছিল। অনেক কিছু লেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁর এই মাধ্যমে। দ্রুত লিখে বাস্তবায়ন করে যেতে চেয়েছিলেন সেসব পরিকল্পনা। প্রায় প্রতিদিন হয় সাক্ষাতে নয় টেলিফোনে তিনি জানাতেন সেসব পরিকল্পনার কথা। বইয়ের জগৎকে তিনি তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রিয় মাধ্যম মনে করতেন। নজরুল মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানে কথা বলতে বলতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। খানিকটা সুস্থ হলে তাঁকে আর হাসপাতালে ধরে রাখা যায়নি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনি বইয়ের জগৎ-এর নতুন সংখ্যা দেখতে চেয়েছিলেন। সেদিনই সন্ধ্যায় রোগাবসন্ন শরীরে সদ্যপ্রকাশিত পত্রিকাটি দেখে যেন স্বস্তি পেয়েছিলেন।

প্রায় ৩০ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কতঘণ্টার যে সাহিত্যিক সাহচর্য তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি! বারবার সমৃদ্ধ করেছি নিজেকে। আমাদের চারপাশের অযোগ্যতাকে অনুভব করেছি তাঁর এমন সাহিত্যমত্ততার মধ্যে। আমাদের সমাজ পরিপাশর্্বকে দেখার একটা স্বতন্ত্র সাহিত্যিক চোখ ছিল তাঁর যা দিয়ে তিনি যেন স্ক্যান করে নিতেন সমাজটাকে। কবিতা-কথাসাহিত্য-প্রবন্ধ-পত্রসাহিত্য এমনভাবে একাকার হয়ে যেত যে অনেক সময় তাঁর রচনাকে ভুল বুঝার অবকাশ ঘটত। অনেকেই বলবেন তাঁর মৃতু্যতে বাংলাসাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় এ কথা দিয়ে তাঁর মহত্ত্ব বা প্রতিভা বা সামর্থ্যকে প্রকাশ করা যায় না। তার কাছ থেকে উত্তরপ্রজন্ম কতটা বঞ্চিত হল তা এ রকম কথায় বর্ণনা করা যাবে না। বাংলাসাহিত্যের সামগ্রিক অনুভবের এক বিস্তীর্ণ জলাশয় ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ_ ত্রয়ী দিকপালকে যে গভীরতায় তিনি পাঠ করেছেন এর সমকক্ষতা আমি আর কারও মধ্যে দেখি না। আমি তাঁর যে নৈকট্য পেয়েছিলাম তার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করি। মৃতু্যর কয়েকঘণ্টা আগেও আমাকে ফোন করেছিলেন তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে। হায় প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আর তাঁর ফোন আসবে না সে পরিকল্পনার কথা বলার জন্য।

Daily Ittefaq, 8th Sep, 2010

Leave a comment